![]() |
পরিণীতা উপন্যাস |
প্রথম পরিচেছদ
গুরুচরণ ষাট টাকা বেতনের ব্যাঙ্কের কেরানী । সুতরাং দেহটিও যেমন ঠিকাগাড়ির ঘােড়ার মত শুষ্ক শীর্ণ , চোখেমুখেও তেমনি তাহাদেরি মত একটা নিষ্কাম নির্বিকার নির্লিপ্ত ভাব । তথাপি এই ভয়ঙ্কর শুভ - সংবাদে আজ তাহার হাতের কাটা হাতেই রহিল , তিনি জীর্ণ পৈতৃক তাকিয়াটা ঠেস দিয়া বসিলেন । একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিবারও আর তাহার জোর রহিল ।
শুড - সংবাদ বহিয়া আনিয়াছিল তাহার তৃতীয় কন্যা দশমবর্ষীয়া আন্নাকালী । সে বলিল , বাবা , চল না দেখবে ।
গুরুচরণ মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন , মা , এক গেলাস জল আন ত খাই । মেয়ে জল আনিতে গেল । সে চলিয়া গেলে , গুরুচরণের সর্বাগ্রে মনে পড়িল সূতিকাগৃহের রকমারি খরচের কথা । তার পরে , ভিড়ের দিনে স্টেশনে গাড়ি আসিলে দোর খােলা পাইলে থার্ড ক্লাসের যাত্রীরা পোটলা - পোটলি লইয়া পাগলের মত যেভাবে লােকজনকে দলিত পিষ্ট করিয়া ঝাপাইয়া আসিতে থাকে , তেমনি মার - মার শব্দ করিয়া তাহার মগজের মধ্যে দুশ্চিন্তারাশি হুহু করিয়া ঢুকিতে লাগিল । মনে পড়িল , গত বৎসর তাহার দ্বিতীয়া কন্যার শুভ বিবাহে বৌবাজারের এই দ্বিতল দ্রাসনটুকু বাঁধা পড়িয়াছে এবং তাহারও ছয় মাসের সুদ বাকী । দুর্গাপূজার আর মাসখানেক মাত্র বিলম্ব আছে - মেজমেয়ের ওখানে তত্ত্ব পাঠাইতে হইবে । অফিসে কাল রাত্রি । টিটা পর্যন্ত ডেবিট ক্রেডিট মিলে নাই , আজ বেলা বারােটার মধ্যে বিলাতে হিসাব পাঠাইতে হইবে । কাল বড়সাহেব হুকুম জারি করিয়াছেন , ময়লা বস্ত্র পরিয়া কেহ অফিসে ঢুকিতে পারিবে না , ফাইন হইবে , অথচ গত সপ্তাহ হইতে ৰজকের সন্ধান মিলিতেছে না , সংসারের অর্ধেক কাপড় - চোপড় লইয়া সে বােধ করি নিরুদ্দেশ । গুরুচরণ আর ঠেস দিয়া থাকিতেও পারিলেন না , কাটা উঁচু করিয়া ধরিয়া এলাইয়া পড়িলেন । মনে মনে বলিলেন , ভগবান , এই কলিকাতা শহরে প্রতিদিন কত লােক গাড়ি - ঘােড়া চাপা পড়িয়া অপঘাতে মরে , তারা কি আমার চেয়েও তােমার পায়ে বেশী অপরাধী ! দয়াময় ! তােমার দয়ায় একটা ভারী মােটরগাড়ি যদি বুকের উপর দিয়া চলিয়া যায় ! আন্নাকালী জল আনিয়া বলিল , বাবা ওঠ , জল এনেছি । গুরুচরণ উঠিয়া সমস্তটুকু এক নিশ্বাসে পান করিয়া ফেলিয়া বলিলেন , আঃ , যা মা , গেলাসটা নিয়ে যা । সে চলিয়া গেলে গুরুচরণ আবার শুইয়া পড়িলেন । ললিতা ঘরে ঢুকিয়া বলিল , মামা , চা এনেচি ওঠ । চায়ের নামে গুরুচরণ আর একবার উঠিয়া বসিলেন । ললিতার মুখের পানে চাহিয়া তাঁহার অর্ধেক জ্বালা যেন নিবিয়া গেল , বলিলেন , সারারাত জেগে আছিস মা , আয় আমার কাছে এসে একবার বস ।
ললিতা সলজ্জহাস্যে কাছে বসিয়া বলিল , আমি রাত্তিরে জাগিনি মামা । এই জীর্ণ শীর্ণ গুরুভারগ্রস্ত অকালবৃদ্ধ মাতুলের হৃদয়ের প্রচ্ছন্ন সুগভীর ব্যথাটা তার চেয়ে বেশী এ সংসারে আর কেহ অনুভব করিত না । গুরুচরণ বলিলেন , তা হােক , আয় , আমার কাছে আয় । ললিতা কাছে আসিয়া বসিতেই গুরুচরণ তাহার মাথায় হাত দিয়া সহসা বলিয়া উঠিলেন , আমার এই মাটিকে যদি রাজার ঘরে দিতে পারতুম , তবেই জানতুম একটা কাজ করুম ।
ললিতা মাথা হেঁট করিয়া চা ঢালিতে লাগিল । তিনি বলিতে লাগিলেন , হাঁ মা , তাের দুঃখী মামার ঘরে এসে দিনরাত্রি খাটতে হয় , না ? ললিতা মাথা নাড়িয়া বলিল , দিবারাত্রি খাটতে হবে কেন মামা ? সবাই কাজ করে , আমিও করি । এইবার গুরুচরণ হাসিলেন । চা খাইতে খাইতে বলিলেন , হাঁ ললিতা , আজ তবে রান্নাবান্নার কি হবে মা ? ললিতা মুখ তুলিয়া বলিল , কেন মামা , আমি রাঁধব যে ! গুরুচরণ বিস্ময় প্রকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন , তুই রাধবি কি মা , রাধতে কি তুই জানিস ? জানি মামা । আমি মামীমার কাছে সব শিখে নিয়েছি । গুরুচরণ চায়ের বাটিটা নামাইয়া ধরিয়া বলিলেন , সত্যি ? সত্যি ! মামীমা দেখিয়ে দেন , -আমি কতদিন রাধি যে । বলিয়াই মুখ নীচু করিল । তাহার আনত মাথার উপর হাত রাখিয়া গুরুচরণ নিঃশব্দে আশীর্বাদ করিলেন । তাহার একটা গুরুতর দুর্ভাবনা দূর হইল । এই ঘরটি গলির উপরেই । চা পান করিতে করিতে জানালার বাহিরে দৃষ্টি পড়ায় গুরুচরণ চেঁচাইয়া ডাকিয়া উঠিলেন , শেখর নাকি ? শােন , শােন । একজন দীর্ঘায়তন বলিষ্ঠ সুন্দর যুবা ঘরে প্রবেশ করিল । গুরুচরণ বলিলেন , বসাে , আজ সকালে তােমার খুড়ীমার কাণ্ডটা শুনেচ বােধ হয় । শেখর মৃদু হাসিয়া বলিল , কাণ্ড আর কি , মেয়ে হয়েছে তাই ? গুরুচরণ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন , তুমি ত বলবে তাই , কিন্তু তাই যে কি সে শুধু আমিই জানি যে । শেখর কহিল , ও - রকম বলবেন না কাকা , খুড়ীমা শুনলে বড় কষ্ট পাবেন । তা ছাড়া ভগবান যাকে পাঠিয়েছেন তাকে আদর - আহাদ করে ডেকে নেওয়া উচিত । গুরুচরণ মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া বলিলেন , আদর - আহ্লাদ করা উচিত , সে আমিও জানি । কিন্তু বাবা , ভগবানও ত সুবিচার করেন না । আমি গরীব , আমার ঘরে এত কেন ? এই বাড়িটুকু পর্যন্ত তােমার বাপের কাছে বাঁধা পড়েছে , তা পড় ক , সে জন্যে দুঃখ করিনে শেখর , কিন্তু এই হাতে - হাতেই দেখ না বাবা , এই যে আমার ললিতা , মাবাপ - মরা সোনার পুতুল , একে শুধু রাজার ঘরেই মানায় । কি করে একে প্রাণ ধরে যার - তার হাতে তুলে দিই বল ত ? রাজার মুকুটে যে কোহিনুর জ্বলে , তেমনি কোহিনুর রাশীকৃত করে আমার এই মাটিকে ওজন করলেও দাম হয় না । কিন্তু কে তা বুঝবে ! পয়সার অভাবে এমন রত্নকেও আমাকে বিলিয়ে দিতে হবে । বল দেখি বাবা , সে - সময়ে কি রকম শেল বুকে বাজবে ? তেরাে বছর বয়স হলাে , কিন্তু হাতে আমার এমন তেরােটা পয়সা নেই যে , একটা সম্বন্ধ পর্যন্ত স্থির করি । গুরুচরণের দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল । শেখর চুপ করিয়া রহিল । গুরুচরণ পুনরায় কহিলেন , শেখরনাথ , দেখােত বাবা , তােমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যদি এই মেয়েটার কোন গতি করে দিতে পার । আজকাল অনেক ছেলে শুনেচি টাকাকড়ির দিকে চেয়ে দেখে না , শুধু মেয়ে দেখেই পছন্দ করে । তেমনি যদি দৈবাৎ একটা মিলে যায় শেখর , তা হলে বলছি আমি , আমার আশীর্বাদে তুমি রাজা হবে । আর কি বলব বাবা , এ পাড়ায় তােমাদের আশ্রয়ে আমি আছি , তােমার বাবা আমাকে ছােট ভায়ের মতই দেখেন । শেখর মাথা নাড়িয়া বলিল , আচ্ছা তা দেখব । গুরুচরণ বলিলেন , ভুলাে না বাবা , দেখাে । ললিতা ত আট বছর বয়স থেকে তােমাদের কাছে লেখাপড়া শিখে মানুষ হচ্ছে , তুমি ত দেখতে পাচ্ছি ও কেমন বুদ্ধিমতী , কেমন শিষ্ট শাড় । একফোটা মেয়ে , আজ থেকে ও - ই আমাদের রাধাবড়া করবে , দেবে - থােবে , সমস্তই এখন ওর মাথায় ।
এই সময়ে ললিতা একটিবার চোখ তুলিয়াই নামাইয়া ফেলিল । তাহার ওষ্ঠাধরের উভয় প্রান্ত ঈষৎ প্রসারিত হইল মাত্র । গুরুচরণ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন , ওর বাপই কি কিছু কম রােজগার করেছে , কিন্তু সমস্তই এমন করে দান করে গেল যে , এই একটা মেয়ের জন্যেও কিছু রেখে গেল না ।
শেখর চুপ করিয়া রহিল । গুরুচরণ নিজেই আবার বলিয়া উঠিলেন , আর রেখে গেল না - ই বা বলি কি করে ? সে যত লােকের যত দুঃখ ঘুচিয়েছে , তার সমস্ত ফলটুকুই আমার এই মাটিকে দিয়ে গেছে , তা নইলে কি এতটুকু মেয়ে এমন অন্নপূর্ণা হতে পারে । তুমিই বল না শেখর , সত্য কি না ? শেখর হাসিতে লাগিল । জবাব দিল না । সে উঠিবার উপক্রম করিতেই গুরুচরণ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিলেন , এমন সকালেই কোথা যাচ্ছ? শেখর বলিল , ব্যারিস্টারের বাড়ি - একটা কেস আছে । বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেই গুরুচরণ আর একবার স্মরণ করাইয়া বলিলেন , কথাটা একটু মনে রেখাে বাবা ! ও একটু শ্যামবর্ণ বটে , কিন্তু চোখমুখ , এমন হাসি , এত দয়ামায়া পৃথিবী খুঁজে বেড়ালেও কেউ পাবে না । শেখর মাথা নাড়িয়া হাসিমুখে বাহির হইয়া গেল । এই ছেলেটির বয়স পঁচিশ - ছাব্বিশ । এম . এম . পাশ করিয়া এতদিন শিক্ষানবিশি করিতেছিল , গত বৎসর হইতে এটর্নি হইয়াছে । তাহার পিতা নবীন রায় গুড়ের কারবারে লক্ষপতি হইয়া কয়েক বৎসর হইতে ব্যবসা ছাড়িয়া দিয়া ঘরে বসিয়া তেজারতি করিতেছিলেন , বড় ছেলে অবিনাশ উকিল , -ছােট ছেলে এই শেখরনাথ । তাঁহার প্রকাণ্ড তেতলা বাড়ি পাড়ার মাথায় উঠিয়াছিল এবং ইহার একটা খােলা ছাদের সহিত গুরুচরণের ছাদটা মিশিয়া থাকায় উভয় পরিবারে অত্যন্ত আত্মীয়তা জন্মিয়াছিল । বাড়ির মেয়েরা এই পথেই যাতায়াত করিত ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
শ্যামবাজারের এক বড়লােকের ঘরে বহুদিন হইতেই শেখরের বিবাহের কথাবার্তা চলিতেছিল । সেদিন তাহারা দেখিতে আসিয়া আগামী মাঘের কোন একটা শুভদিন স্থির করিয়া যাইতে চাহিলেন । কিন্তু শেখরের জননী স্বীব করিলেন না । ঝিকে দিয়া বলিয়া ইলেন , ছেলে নিজে দেখিয়া পছন্দ করিলে তবে বিবাহ দিব ।
নবীন রায়ের চোখ ছিল শুধু টাকার দিকে , তিনি গৃহিণীর এই গােলমেলে কথায় অপ্রসন্ন । হইয়া বলিলেন , এ আবার কি কথা ! মেয়ে ত দেখাই আছে । কথাবার্তা পাকা হয়ে যাক , তার পরে আশীর্বাদ করার দিন ভাল করে দেখলেই হবে ।
তথাপি গৃহিণী সম্মত হইলেন না , পাকা কথা কহিতে দিলেন না । নবীন রায় সেদিন রাগ করিয়া অনেক বেলায় আহার করিলেন এবং দিবান্দ্রিাটা বাহিরের ঘরেই দিলেন ।
শেখরনাথ লােকটা কিছু শৌখিন । সে তেতলায় যে ঘরটিতে থাকে , সেটি অতিশয় সুসজ্জিত । দিন পাঁচ - ছয় পরে একদিন অপরাহ্নবেলায় সে সেই ঘরের বড় আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া মেয়ে দেখিতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল , ললিতা ঘরে ঢুকিল । ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল , বৌ দেখতে যাবে , না ?
শেখর ফিরিয়া চাহিয়া বলিল , এই যে ! কৈ বেশ করে সাজিয়ে দাও দেখি বৌ যাতে পছন্দ করে ।
ললিতা হাসিল । বলিল , এখন ত আমার সময় নেই শেখরদা - আমি টাকা নিতে এসেছি , বলিয়া বালিশের তলা হইতে চাবি লইয়া একটা দেরাজ খুলিয়া গণিয়া গণিয়া গুটিকয়েক টাকা আঁচলে বাঁধিয়া লইয়া যেন কতকটা নিজের মনেই বলিল , টাকা ত দরকার হলেই নিয়ে যাচ্ছি , কিন্তু এ শােধ হবে কি করে ?
শেখর চুলের একপাশ বুরুশ দিয়া সযত্নে উপরের দিকে তুলিয়া দিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল , শােধ হবে , না হচ্ছে ।
ললিতা বুঝিতে পারিল না , চাহিয়া রহিল । শেখর বলিল , চেয়ে রইলে , বুঝতে পারলে না ? ললিতা মাথা নাড়িয়া বলিল , না । আরও একটু বড় হও , তখন বুঝতে পারবে , বলিয়া শেখর জুতা পায়ে দিয়া বাহির হইয়া গৈল ।
শেখর মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিল , বেশ । শেখরের মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী । বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছে আসিয়াছিল , কিন্তু এমনি সুন্দর তাহার দেহের বাঁধন যে দেখিলে পঁয়ত্রিশ - ছত্রিশের অধিক মনে হইত না । আবার এই সুন্দর আবরণের মধ্যে যে মাতৃহৃদয়টি ছিল , তাহা আরও নবীন আরও কোমল । তিনি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে ; পাড়াগাঁয়ে জন্মিয়া সেইখানেই বড় হইয়াছিলেন বটে , কিন্তু শহরের মধ্যে তাঁহাকে একদিনের জন্য বেমানান দেখায় নাই । শহরের চাঞ্চল্যসজীবতা এবং আচার ব্যবহারও যেন তিনি স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করিতে পারিয়াছিলেন , জন্মভূমির নিবিড় নিস্তব্ধতা ও মাধুর্যও তেমনি হারাইয়া ফেলেন নাই । এই মাটি যে শেখরের কত বড় গর্বের বস্তু ছিল , সে কথা তাহার মা - ও জানিতেন না । জগদীশ্বর শেখরকে অনেক বস্তু দিয়াছিলেন । অনন্যসাধারণ স্বাস্থ্য , রূপ , ঐশ্বর্য , বুদ্ধি - কিন্তু এই জননীর সন্তান হইতে পারার ভাগ্যটাকেই সে কায়মনে ভগবানের সবচেয়ে বড় দান বলিয়া মনে করিত ।
মা বলিলেন , ' বেশ ' বলে চুপ করে রইলি যে রে ! শেখর আবার হাসিয়া মুখ নীচু করিয়া বলিল , যা জিজ্ঞেস করলে তাই ত বললুম । মা - ও হাসিলেন । বলিলেন , কৈ বললি ? রঙ কেমন , ফরসা ? কার মত হবে ? আমাদের ললিতার মত? শেখর মুখ তুলিয়া বলিল , ললিতা ত কালাে মা , ওর চেয়ে ফরসা । মুখচোখ কেমন ? তাও মন্দ নয় । তবে কর্তাকে বলি ? এবার শেখর চুপ করিয়া রহিল । মা ক্ষণকাল পুত্রের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিলেন , হাঁ রে , মেয়েটি লেখাপড়া শিখেচে কেমন ? শেখর বলিল , সে ত জিজ্ঞাসা করিনি মা ! অতিশয় আশ্চর্য হইয়া মা বলিলেন , জিজ্ঞেস করিস নি কি রে ! যেটা আজকাল তােদের সবচেয়ে দরকারী জিনিস , সেইটেই জেনে আসিস নি ? শেখর হাসিয়া বলিল , না মা , ওকথা আমার মনেই ছিল না । ছেলের কথা শুনিয়া এবার তিনি অতিশয় বিস্মিত হইয়া ক্ষণকাল তাহার মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন , তবে তুই ওখানে বিয়ে করবি নে দেখচি । শেখর কি একটা বুলিতে যাইতেছিল , কিন্তু এই সময় ললিতাকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া চুপ করিয়া গেল । ললিতা ধীরে ধীরে ভুবনেশ্বরীর পিছনে আসিয়া দাঁড়াইল । তিনি বাঁ হাত দিয়া তাহাকে সমুখের দিকে টানিয়া আনিয়া বলিলেন , কি মা ? ললিতা চুপি চুপি বলিল , কিছু না মা । ললিতা পূর্বে হঁহাকে মাসীমা বলিত , কিন্তু তিনি নিষেধ করিয়া দিয়া বলিয়াছিলেন , তাের আমি ত মাসী হইনে ললিতে , মা হই । তখন হইতে সে মা বলিয়া ডাকিত । ভুবনেশ্বরী তাহাকে বুকের আরাে কাছে টানিয়া লইয়া আদর করিয়া বলিলেন , কিছু না ? তবে বুঝি আমাকে শুধু একবার দেখতে এসেছিস ? ললিতা চুপ করিয়া রহিল । শেখর কহিল , দেখতে এসেচে , রাঁধবে কখন ? মা বলিলেন , রাধবে কেন ? শেখর আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল , কে তবে ওদের রাধবে মা ? ওর মামাও ত সেদিন বললেন , ললিতাই রাধাবাড়া সব কাজ করবে । মা হাসিয়া উঠিলেন । বলিলেন , ওর মামার কি , যা হােক একটা বললেই হল । ওর বিয়ে হয়নি , ওর হাতে খাবে কে ? আমাদের বামুনঠাকরুনকে পাঠিয়ে দিয়েছি , তিনি রাঁধবেন । বড়বৌমা আমাদের রান্নাবান্না করচেন - আমি দুপুরবেলা ওদের বাড়িতেই আজকাল খাই । শেখর বুঝিল , মা এই দুঃখী পরিবারের গুরুভার হাতে তুলিয়া লইয়াছেন । সে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিল ।
মাসখানেক পরে একদিন সন্ধ্যার পর শেখর নিজের ঘরে কোচের উপর কাত হইয়া একখানি ইংরাজী নভেল পড়িতেছিল । বেশ মন লাগিয়া গিয়াছিল , এমন সময় ললিতা ঘরে ঢুকিয়া বালিশের তলা হইতে চাবি লইয়া শব্দ - সাড়া করিয়া দেরাজ খুলিতে লাগিল । শেখর বই হইতে মুখ না তুলিয়াই বলিল , কি?
ললিতা বলিল , টাকা নিচ্ছি । হু , বলিয়া শেখর পড়িতে লাগিল । ললিতা আঁচলে টাকা বাঁধিয়া উঠিয়া দাড়াইল । আজ সে সাজিয়া - গুজিয়া আসিয়াছিল , তাহার ইচ্ছা শেখর চাহিয়া দেখে । কহিল , দশ টাকা নিলুম শেখরদা । শেখর ‘ আচ্ছা বলিল , কিন্তু চাহিয়া দেখিল না । অগত্যা সে এটা - ওটা নাড়িতে লাগিল , মিছামিছি দেরি করিতে লাগিল , কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হইল না , তখন ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল । কিন্তু গেলেই ত চলে না , আবার তাহাকে ফিরিয়া আসিয়া দোরগােড়ায় দাঁড়াইতে হইল । আজ তাহারা থিয়েটার দেখিতে যাইবে । শেখরের বিনা হুকুমে সে যে কোথাও যাইতে পারে না , ইহা সে জানিত । কেহই তাহাকে ইহা বলিয়া দেয় নাই , কিংবা কেন , কি জন্য , এ - সব তর্কও কোনদিন মনে উঠে নাই । কিন্তু জীবমাত্রেরই যে একটা স্বাভাবিক সহজবুদ্ধি আছে , সেই বুদ্ধিই তাহাকে শিখাইয়া দিয়াছিল ; অপরে যাহা ইচ্ছা করিতে পারে যেখানে খুশি যাইতে পারে , কিন্তু সে পারে না । সে স্বাধীনও নয় এবং মামা - মামীর অনুমতিই তাহার পক্ষে যথেষ্ট নয় । সে দ্বারের অন্তরালে দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল , আমরা যে থিয়েটার দেখতে যাচ্ছি ।
তাহার মৃদু শেখরের কানে গেল না - সে জবাব দিল না । ললিতা তখন আরাে একটু গলা চড়াইয়া বলিল , সবাই আমার জন্য দাড়িয়ে রয়েছে যে । এবার শেখর শুনিতে পাইল , বইখানা একপাশে নামাইয়া রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিল , কি হয়েছে ? ললিতা একটুখানি রুষ্টভাবে বলিল , এতক্ষণে বুঝি কানে গেল । আমরা থিয়েটারে যাচ্ছি যে । শেখর বলিল , আমরা কারা ? আমি , আন্নাকালী , চারুবালা , তার মামা । মামাটি কে ? ললিতা বলিল , তার নাম গিরীনবাবু । পাঁচ - ছদিন হ'লাে মুঙ্গেরের বাড়ি থেকে এসেছেন , এখানে বি . এ . পড়বেন - বেশ লােক সে- বাঃ - নাম , ধাম , পেশা - এ যে দিব্যি আলাপ হয়ে গেছে দেখচি । তাতেই চার - পাঁচ দিন মাথার টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পাইনি - তাস খেলা হচ্ছিল বােধ করি ?
Dear JF Anika,
ReplyDeleteyour article was good but not excellent and also your page loading speed was so worst, from mobile it's only 19 & from Desktop just 61 score, it's very bad thing, try to improve it otherwise you lost everything from google.
Best Regards,
buffer.com
Thanks
Delete