পরিণীতা | ❤️ পরিণীতা উপন্যাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ❤️ | পরিণীতা উপন্যাস pdf download

পরিণীতা উপন্যাস
পরিণীতা উপন্যাস


প্রথম পরিচেছদ

শক্তিশেল বুকে পড়িবার সময় লক্ষ্মণের মুখের ভাব নিশ্চয় খুব খারাপ হইয়া গিয়াছিল , কিন্তু গুরুচরণের চেহারাটা বােধ করি তার চেয়েও মন্দ দেখাইল - যখন প্রত্যুষেই অন্তঃপুর হইতে সংবাদ পৌছিল , গৃহিণী এইমাত্র নির্বিঘ্নে পঞ্চম কন্যার জন্মদান করিয়াছেন ।

গুরুচরণ ষাট টাকা বেতনের ব্যাঙ্কের কেরানী । সুতরাং দেহটিও যেমন ঠিকাগাড়ির ঘােড়ার মত শুষ্ক শীর্ণ , চোখেমুখেও তেমনি তাহাদেরি মত একটা নিষ্কাম নির্বিকার নির্লিপ্ত ভাব । তথাপি এই ভয়ঙ্কর শুভ - সংবাদে আজ তাহার হাতের কাটা হাতেই রহিল , তিনি জীর্ণ পৈতৃক তাকিয়াটা ঠেস দিয়া বসিলেন । একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিবারও আর তাহার জোর রহিল ।

শুড - সংবাদ বহিয়া আনিয়াছিল তাহার তৃতীয় কন্যা দশমবর্ষীয়া আন্নাকালী । সে বলিল , বাবা , চল না দেখবে ।

গুরুচরণ মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন , মা , এক গেলাস জল আন ত খাই । মেয়ে জল আনিতে গেল । সে চলিয়া গেলে , গুরুচরণের সর্বাগ্রে মনে পড়িল সূতিকাগৃহের রকমারি খরচের কথা । তার পরে , ভিড়ের দিনে স্টেশনে গাড়ি আসিলে দোর খােলা পাইলে থার্ড ক্লাসের যাত্রীরা পোটলা - পোটলি লইয়া পাগলের মত যেভাবে লােকজনকে দলিত পিষ্ট করিয়া ঝাপাইয়া আসিতে থাকে , তেমনি মার - মার শব্দ করিয়া তাহার মগজের মধ্যে দুশ্চিন্তারাশি হুহু করিয়া ঢুকিতে লাগিল । মনে পড়িল , গত বৎসর তাহার দ্বিতীয়া কন্যার শুভ বিবাহে বৌবাজারের এই দ্বিতল দ্রাসনটুকু বাঁধা পড়িয়াছে এবং তাহারও ছয় মাসের সুদ বাকী । দুর্গাপূজার আর মাসখানেক মাত্র বিলম্ব আছে - মেজমেয়ের ওখানে তত্ত্ব পাঠাইতে হইবে । অফিসে কাল রাত্রি । টিটা পর্যন্ত ডেবিট ক্রেডিট মিলে নাই , আজ বেলা বারােটার মধ্যে বিলাতে হিসাব পাঠাইতে হইবে । কাল বড়সাহেব হুকুম জারি করিয়াছেন , ময়লা বস্ত্র পরিয়া কেহ অফিসে ঢুকিতে পারিবে না , ফাইন হইবে , অথচ গত সপ্তাহ হইতে ৰজকের সন্ধান মিলিতেছে না , সংসারের অর্ধেক কাপড় - চোপড় লইয়া সে বােধ করি নিরুদ্দেশ । গুরুচরণ আর ঠেস দিয়া থাকিতেও পারিলেন না , কাটা উঁচু করিয়া ধরিয়া এলাইয়া পড়িলেন । মনে মনে বলিলেন , ভগবান , এই কলিকাতা শহরে প্রতিদিন কত লােক গাড়ি - ঘােড়া চাপা পড়িয়া অপঘাতে মরে , তারা কি আমার চেয়েও তােমার পায়ে বেশী অপরাধী ! দয়াময় ! তােমার দয়ায় একটা ভারী মােটরগাড়ি যদি বুকের উপর দিয়া চলিয়া যায় ! আন্নাকালী জল আনিয়া বলিল , বাবা ওঠ , জল এনেছি । গুরুচরণ উঠিয়া সমস্তটুকু এক নিশ্বাসে পান করিয়া ফেলিয়া বলিলেন , আঃ , যা মা , গেলাসটা নিয়ে যা । সে চলিয়া গেলে গুরুচরণ আবার শুইয়া পড়িলেন । ললিতা ঘরে ঢুকিয়া বলিল , মামা , চা এনেচি ওঠ । চায়ের নামে গুরুচরণ আর একবার উঠিয়া বসিলেন । ললিতার মুখের পানে চাহিয়া তাঁহার অর্ধেক জ্বালা যেন নিবিয়া গেল , বলিলেন , সারারাত জেগে আছিস মা , আয় আমার কাছে এসে একবার বস ।

ললিতা সলজ্জহাস্যে কাছে বসিয়া বলিল , আমি রাত্তিরে জাগিনি মামা । এই জীর্ণ শীর্ণ গুরুভারগ্রস্ত অকালবৃদ্ধ মাতুলের হৃদয়ের প্রচ্ছন্ন সুগভীর ব্যথাটা তার চেয়ে বেশী এ সংসারে আর কেহ অনুভব করিত না । গুরুচরণ বলিলেন , তা হােক , আয় , আমার কাছে আয় । ললিতা কাছে আসিয়া বসিতেই গুরুচরণ তাহার মাথায় হাত দিয়া সহসা বলিয়া উঠিলেন , আমার এই মাটিকে যদি রাজার ঘরে দিতে পারতুম , তবেই জানতুম একটা কাজ করুম ।

ললিতা মাথা হেঁট করিয়া চা ঢালিতে লাগিল । তিনি বলিতে লাগিলেন , হাঁ মা , তাের দুঃখী মামার ঘরে এসে দিনরাত্রি খাটতে হয় , না ? ললিতা মাথা নাড়িয়া বলিল , দিবারাত্রি খাটতে হবে কেন মামা ? সবাই কাজ করে , আমিও করি । এইবার গুরুচরণ হাসিলেন । চা খাইতে খাইতে বলিলেন , হাঁ ললিতা , আজ তবে রান্নাবান্নার কি হবে মা ? ললিতা মুখ তুলিয়া বলিল , কেন মামা , আমি রাঁধব যে ! গুরুচরণ বিস্ময় প্রকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন , তুই রাধবি কি মা , রাধতে কি তুই জানিস ? জানি মামা । আমি মামীমার কাছে সব শিখে নিয়েছি । গুরুচরণ চায়ের বাটিটা নামাইয়া ধরিয়া বলিলেন , সত্যি ? সত্যি ! মামীমা দেখিয়ে দেন , -আমি কতদিন রাধি যে । বলিয়াই মুখ নীচু করিল । তাহার আনত মাথার উপর হাত রাখিয়া গুরুচরণ নিঃশব্দে আশীর্বাদ করিলেন । তাহার একটা গুরুতর দুর্ভাবনা দূর হইল । এই ঘরটি গলির উপরেই । চা পান করিতে করিতে জানালার বাহিরে দৃষ্টি পড়ায় গুরুচরণ চেঁচাইয়া ডাকিয়া উঠিলেন , শেখর নাকি ? শােন , শােন । একজন দীর্ঘায়তন বলিষ্ঠ সুন্দর যুবা ঘরে প্রবেশ করিল । গুরুচরণ বলিলেন , বসাে , আজ সকালে তােমার খুড়ীমার কাণ্ডটা শুনেচ বােধ হয় । শেখর মৃদু হাসিয়া বলিল , কাণ্ড আর কি , মেয়ে হয়েছে তাই ? গুরুচরণ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন , তুমি ত বলবে তাই , কিন্তু তাই যে কি সে শুধু আমিই জানি যে । শেখর কহিল , ও - রকম বলবেন না কাকা , খুড়ীমা শুনলে বড় কষ্ট পাবেন । তা ছাড়া ভগবান যাকে পাঠিয়েছেন তাকে আদর - আহাদ করে ডেকে নেওয়া উচিত । গুরুচরণ মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া বলিলেন , আদর - আহ্লাদ করা উচিত , সে আমিও জানি । কিন্তু বাবা , ভগবানও ত সুবিচার করেন না । আমি গরীব , আমার ঘরে এত কেন ? এই বাড়িটুকু পর্যন্ত তােমার বাপের কাছে বাঁধা পড়েছে , তা পড় ক , সে জন্যে দুঃখ করিনে শেখর , কিন্তু এই হাতে - হাতেই দেখ না বাবা , এই যে আমার ললিতা , মাবাপ - মরা সোনার পুতুল , একে শুধু রাজার ঘরেই মানায় । কি করে একে প্রাণ ধরে যার - তার হাতে তুলে দিই বল ত ? রাজার মুকুটে যে কোহিনুর জ্বলে , তেমনি কোহিনুর রাশীকৃত করে আমার এই মাটিকে ওজন করলেও দাম হয় না । কিন্তু কে তা বুঝবে ! পয়সার অভাবে এমন রত্নকেও আমাকে বিলিয়ে দিতে হবে । বল দেখি বাবা , সে - সময়ে কি রকম শেল বুকে বাজবে ? তেরাে বছর বয়স হলাে , কিন্তু হাতে আমার এমন তেরােটা পয়সা নেই যে , একটা সম্বন্ধ পর্যন্ত স্থির করি । গুরুচরণের দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল । শেখর চুপ করিয়া রহিল । গুরুচরণ পুনরায় কহিলেন , শেখরনাথ , দেখােত বাবা , তােমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যদি এই মেয়েটার কোন গতি করে দিতে পার । আজকাল অনেক ছেলে শুনেচি টাকাকড়ির দিকে চেয়ে দেখে না , শুধু মেয়ে দেখেই পছন্দ করে । তেমনি যদি দৈবাৎ একটা মিলে যায় শেখর , তা হলে বলছি আমি , আমার আশীর্বাদে তুমি রাজা হবে । আর কি বলব বাবা , এ পাড়ায় তােমাদের আশ্রয়ে আমি আছি , তােমার বাবা আমাকে ছােট ভায়ের মতই দেখেন । শেখর মাথা নাড়িয়া বলিল , আচ্ছা তা দেখব । গুরুচরণ বলিলেন , ভুলাে না বাবা , দেখাে । ললিতা ত আট বছর বয়স থেকে তােমাদের কাছে লেখাপড়া শিখে মানুষ হচ্ছে , তুমি ত দেখতে পাচ্ছি ও কেমন বুদ্ধিমতী , কেমন শিষ্ট শাড় । একফোটা মেয়ে , আজ থেকে ও - ই আমাদের রাধাবড়া করবে , দেবে - থােবে , সমস্তই এখন ওর মাথায় ।

এই সময়ে ললিতা একটিবার চোখ তুলিয়াই নামাইয়া ফেলিল । তাহার ওষ্ঠাধরের উভয় প্রান্ত ঈষৎ প্রসারিত হইল মাত্র । গুরুচরণ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন , ওর বাপই কি কিছু কম রােজগার করেছে , কিন্তু সমস্তই এমন করে দান করে গেল যে , এই একটা মেয়ের জন্যেও কিছু রেখে গেল না ।

শেখর চুপ করিয়া রহিল । গুরুচরণ নিজেই আবার বলিয়া উঠিলেন , আর রেখে গেল না - ই বা বলি কি করে ? সে যত লােকের যত দুঃখ ঘুচিয়েছে , তার সমস্ত ফলটুকুই আমার এই মাটিকে দিয়ে গেছে , তা নইলে কি এতটুকু মেয়ে এমন অন্নপূর্ণা হতে পারে । তুমিই বল না শেখর , সত্য কি না ? শেখর হাসিতে লাগিল । জবাব দিল না । সে উঠিবার উপক্রম করিতেই গুরুচরণ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিলেন , এমন সকালেই কোথা যাচ্ছ? শেখর বলিল , ব্যারিস্টারের বাড়ি - একটা কেস আছে । বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেই গুরুচরণ আর একবার স্মরণ করাইয়া বলিলেন , কথাটা একটু মনে রেখাে বাবা ! ও একটু শ্যামবর্ণ বটে , কিন্তু চোখমুখ , এমন হাসি , এত দয়ামায়া পৃথিবী খুঁজে বেড়ালেও কেউ পাবে না । শেখর মাথা নাড়িয়া হাসিমুখে বাহির হইয়া গেল । এই ছেলেটির বয়স পঁচিশ - ছাব্বিশ । এম . এম . পাশ করিয়া এতদিন শিক্ষানবিশি করিতেছিল , গত বৎসর হইতে এটর্নি হইয়াছে । তাহার পিতা নবীন রায় গুড়ের কারবারে লক্ষপতি হইয়া কয়েক বৎসর হইতে ব্যবসা ছাড়িয়া দিয়া ঘরে বসিয়া তেজারতি করিতেছিলেন , বড় ছেলে অবিনাশ উকিল , -ছােট ছেলে এই শেখরনাথ । তাঁহার প্রকাণ্ড তেতলা বাড়ি পাড়ার মাথায় উঠিয়াছিল এবং ইহার একটা খােলা ছাদের সহিত গুরুচরণের ছাদটা মিশিয়া থাকায় উভয় পরিবারে অত্যন্ত আত্মীয়তা জন্মিয়াছিল । বাড়ির মেয়েরা এই পথেই যাতায়াত করিত ।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

শ্যামবাজারের এক বড়লােকের ঘরে বহুদিন হইতেই শেখরের বিবাহের কথাবার্তা চলিতেছিল । সেদিন তাহারা দেখিতে আসিয়া আগামী মাঘের কোন একটা শুভদিন স্থির করিয়া যাইতে চাহিলেন । কিন্তু শেখরের জননী স্বীব করিলেন না । ঝিকে দিয়া বলিয়া ইলেন , ছেলে নিজে দেখিয়া পছন্দ করিলে তবে বিবাহ দিব ।

নবীন রায়ের চোখ ছিল শুধু টাকার দিকে , তিনি গৃহিণীর এই গােলমেলে কথায় অপ্রসন্ন । হইয়া বলিলেন , এ আবার কি কথা ! মেয়ে ত দেখাই আছে । কথাবার্তা পাকা হয়ে যাক , তার পরে আশীর্বাদ করার দিন ভাল করে দেখলেই হবে ।

তথাপি গৃহিণী সম্মত হইলেন না , পাকা কথা কহিতে দিলেন না । নবীন রায় সেদিন রাগ করিয়া অনেক বেলায় আহার করিলেন এবং দিবান্দ্রিাটা বাহিরের ঘরেই দিলেন ।

শেখরনাথ লােকটা কিছু শৌখিন । সে তেতলায় যে ঘরটিতে থাকে , সেটি অতিশয় সুসজ্জিত । দিন পাঁচ - ছয় পরে একদিন অপরাহ্নবেলায় সে সেই ঘরের বড় আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া মেয়ে দেখিতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল , ললিতা ঘরে ঢুকিল । ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল , বৌ দেখতে যাবে , না ?

শেখর ফিরিয়া চাহিয়া বলিল , এই যে ! কৈ বেশ করে সাজিয়ে দাও দেখি বৌ যাতে পছন্দ করে ।

ললিতা হাসিল । বলিল , এখন ত আমার সময় নেই শেখরদা - আমি টাকা নিতে এসেছি , বলিয়া বালিশের তলা হইতে চাবি লইয়া একটা দেরাজ খুলিয়া গণিয়া গণিয়া গুটিকয়েক টাকা আঁচলে বাঁধিয়া লইয়া যেন কতকটা নিজের মনেই বলিল , টাকা ত দরকার হলেই নিয়ে যাচ্ছি , কিন্তু এ শােধ হবে কি করে ?

শেখর চুলের একপাশ বুরুশ দিয়া সযত্নে উপরের দিকে তুলিয়া দিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল , শােধ হবে , না হচ্ছে ।

ললিতা বুঝিতে পারিল না , চাহিয়া রহিল । শেখর বলিল , চেয়ে রইলে , বুঝতে পারলে না ? ললিতা মাথা নাড়িয়া বলিল , না । আরও একটু বড় হও , তখন বুঝতে পারবে , বলিয়া শেখর জুতা পায়ে দিয়া বাহির হইয়া গৈল ।


রাত্রে শেখর একটা কোচের উপর চুপ করিয়া শুইয়া ছিল , মা আসিয়া ঘরে ঢুকিলেন । সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল । মা একটা চৌকির উপর বসিয়া পড়িয়া বলিলেন , মেয়ে কি রকম । দেখে এলি রে ?

শেখর মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিল , বেশ । শেখরের মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী । বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছে আসিয়াছিল , কিন্তু এমনি সুন্দর তাহার দেহের বাঁধন যে দেখিলে পঁয়ত্রিশ - ছত্রিশের অধিক মনে হইত না । আবার এই সুন্দর আবরণের মধ্যে যে মাতৃহৃদয়টি ছিল , তাহা আরও নবীন আরও কোমল । তিনি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে ; পাড়াগাঁয়ে জন্মিয়া সেইখানেই বড় হইয়াছিলেন বটে , কিন্তু শহরের মধ্যে তাঁহাকে একদিনের জন্য বেমানান দেখায় নাই । শহরের চাঞ্চল্যসজীবতা এবং আচার ব্যবহারও যেন তিনি স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করিতে পারিয়াছিলেন , জন্মভূমির নিবিড় নিস্তব্ধতা ও মাধুর্যও তেমনি হারাইয়া ফেলেন নাই । এই মাটি যে শেখরের কত বড় গর্বের বস্তু ছিল , সে কথা তাহার মা - ও জানিতেন না । জগদীশ্বর শেখরকে অনেক বস্তু দিয়াছিলেন । অনন্যসাধারণ স্বাস্থ্য , রূপ , ঐশ্বর্য , বুদ্ধি - কিন্তু এই জননীর সন্তান হইতে পারার ভাগ্যটাকেই সে কায়মনে ভগবানের সবচেয়ে বড় দান বলিয়া মনে করিত ।

মা বলিলেন , ' বেশ ' বলে চুপ করে রইলি যে রে ! শেখর আবার হাসিয়া মুখ নীচু করিয়া বলিল , যা জিজ্ঞেস করলে তাই ত বললুম । মা - ও হাসিলেন । বলিলেন , কৈ বললি ? রঙ কেমন , ফরসা ? কার মত হবে ? আমাদের ললিতার মত? শেখর মুখ তুলিয়া বলিল , ললিতা ত কালাে মা , ওর চেয়ে ফরসা । মুখচোখ কেমন ? তাও মন্দ নয় । তবে কর্তাকে বলি ? এবার শেখর চুপ করিয়া রহিল । মা ক্ষণকাল পুত্রের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিলেন , হাঁ রে , মেয়েটি লেখাপড়া শিখেচে কেমন ? শেখর বলিল , সে ত জিজ্ঞাসা করিনি মা ! অতিশয় আশ্চর্য হইয়া মা বলিলেন , জিজ্ঞেস করিস নি কি রে ! যেটা আজকাল তােদের সবচেয়ে দরকারী জিনিস , সেইটেই জেনে আসিস নি ? শেখর হাসিয়া বলিল , না মা , ওকথা আমার মনেই ছিল না । ছেলের কথা শুনিয়া এবার তিনি অতিশয় বিস্মিত হইয়া ক্ষণকাল তাহার মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন , তবে তুই ওখানে বিয়ে করবি নে দেখচি । শেখর কি একটা বুলিতে যাইতেছিল , কিন্তু এই সময় ললিতাকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া চুপ করিয়া গেল । ললিতা ধীরে ধীরে ভুবনেশ্বরীর পিছনে আসিয়া দাঁড়াইল । তিনি বাঁ হাত দিয়া তাহাকে সমুখের দিকে টানিয়া আনিয়া বলিলেন , কি মা ? ললিতা চুপি চুপি বলিল , কিছু না মা । ললিতা পূর্বে হঁহাকে মাসীমা বলিত , কিন্তু তিনি নিষেধ করিয়া দিয়া বলিয়াছিলেন , তাের আমি ত মাসী হইনে ললিতে , মা হই । তখন হইতে সে মা বলিয়া ডাকিত । ভুবনেশ্বরী তাহাকে বুকের আরাে কাছে টানিয়া লইয়া আদর করিয়া বলিলেন , কিছু না ? তবে বুঝি আমাকে শুধু একবার দেখতে এসেছিস ? ললিতা চুপ করিয়া রহিল । শেখর কহিল , দেখতে এসেচে , রাঁধবে কখন ? মা বলিলেন , রাধবে কেন ? শেখর আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল , কে তবে ওদের রাধবে মা ? ওর মামাও ত সেদিন বললেন , ললিতাই রাধাবাড়া সব কাজ করবে । মা হাসিয়া উঠিলেন । বলিলেন , ওর মামার কি , যা হােক একটা বললেই হল । ওর বিয়ে হয়নি , ওর হাতে খাবে কে ? আমাদের বামুনঠাকরুনকে পাঠিয়ে দিয়েছি , তিনি রাঁধবেন । বড়বৌমা আমাদের রান্নাবান্না করচেন - আমি দুপুরবেলা ওদের বাড়িতেই আজকাল খাই । শেখর বুঝিল , মা এই দুঃখী পরিবারের গুরুভার হাতে তুলিয়া লইয়াছেন । সে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিল ।

মাসখানেক পরে একদিন সন্ধ্যার পর শেখর নিজের ঘরে কোচের উপর কাত হইয়া একখানি ইংরাজী নভেল পড়িতেছিল । বেশ মন লাগিয়া গিয়াছিল , এমন সময় ললিতা ঘরে ঢুকিয়া বালিশের তলা হইতে চাবি লইয়া শব্দ - সাড়া করিয়া দেরাজ খুলিতে লাগিল । শেখর বই হইতে মুখ না তুলিয়াই বলিল , কি?

ললিতা বলিল , টাকা নিচ্ছি । হু , বলিয়া শেখর পড়িতে লাগিল । ললিতা আঁচলে টাকা বাঁধিয়া উঠিয়া দাড়াইল । আজ সে সাজিয়া - গুজিয়া আসিয়াছিল , তাহার ইচ্ছা শেখর চাহিয়া দেখে । কহিল , দশ টাকা নিলুম শেখরদা । শেখর ‘ আচ্ছা বলিল , কিন্তু চাহিয়া দেখিল না । অগত্যা সে এটা - ওটা নাড়িতে লাগিল , মিছামিছি দেরি করিতে লাগিল , কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হইল না , তখন ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল । কিন্তু গেলেই ত চলে না , আবার তাহাকে ফিরিয়া আসিয়া দোরগােড়ায় দাঁড়াইতে হইল । আজ তাহারা থিয়েটার দেখিতে যাইবে । শেখরের বিনা হুকুমে সে যে কোথাও যাইতে পারে না , ইহা সে জানিত । কেহই তাহাকে ইহা বলিয়া দেয় নাই , কিংবা কেন , কি জন্য , এ - সব তর্কও কোনদিন মনে উঠে নাই । কিন্তু জীবমাত্রেরই যে একটা স্বাভাবিক সহজবুদ্ধি আছে , সেই বুদ্ধিই তাহাকে শিখাইয়া দিয়াছিল ; অপরে যাহা ইচ্ছা করিতে পারে যেখানে খুশি যাইতে পারে , কিন্তু সে পারে না । সে স্বাধীনও নয় এবং মামা - মামীর অনুমতিই তাহার পক্ষে যথেষ্ট নয় । সে দ্বারের অন্তরালে দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল , আমরা যে থিয়েটার দেখতে যাচ্ছি ।

তাহার মৃদু শেখরের কানে গেল না - সে জবাব দিল না । ললিতা তখন আরাে একটু গলা চড়াইয়া বলিল , সবাই আমার জন্য দাড়িয়ে রয়েছে যে । এবার শেখর শুনিতে পাইল , বইখানা একপাশে নামাইয়া রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিল , কি হয়েছে ? ললিতা একটুখানি রুষ্টভাবে বলিল , এতক্ষণে বুঝি কানে গেল । আমরা থিয়েটারে যাচ্ছি যে । শেখর বলিল , আমরা কারা ? আমি , আন্নাকালী , চারুবালা , তার মামা । মামাটি কে ? ললিতা বলিল , তার নাম গিরীনবাবু । পাঁচ - ছদিন হ'লাে মুঙ্গেরের বাড়ি থেকে এসেছেন , এখানে বি . এ . পড়বেন - বেশ লােক সে- বাঃ - নাম , ধাম , পেশা - এ যে দিব্যি আলাপ হয়ে গেছে দেখচি । তাতেই চার - পাঁচ দিন মাথার টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পাইনি - তাস খেলা হচ্ছিল বােধ করি ?
JF Anika

যদি এই ওয়েবসাইটে লেখাগুলো ভালো লাগে তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করবেন। এবং আমাদের পাশে থাকবেন। আল্লাহ আপনাদের সকলের মঙ্গল করুক। (আমিন)

2 Comments

Thanks for reading my writing, JF Anika.

ধন্যবাদ আমার লেখা গুলো পড়ার জন্য, জে.এফ আনিকা।

  1. Dear JF Anika,
    your article was good but not excellent and also your page loading speed was so worst, from mobile it's only 19 & from Desktop just 61 score, it's very bad thing, try to improve it otherwise you lost everything from google.
    Best Regards,
    buffer.com

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post